ভয়েস বার্তা ডেস্ক:
গতকাল বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সুদৃঢ় ঐক্য, দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো বিশ্ব তাবলিগ জামাত আয়োজিত ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব।
আখেরি মোনাজাতে লাখো লাখো ধর্মপ্রাণ মুসল্লীর অশ্রসিক্ত নয়নে আহাজারি ও আমিন আমিন ধ্বনিতে কয়েক বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। এসময় সকলেই নিজ নিজ গুনাহ মাফ, সারা দুনিয়ার কল্যাণ কামনা, আল্লাহর নৈকট্য লাভ, দুনিয়াতে হানাহানি, মারামারিমুক্ত শান্তিময় সমাজ কামনা এবং ইহ ও পারলৌকিক সুখ-শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে আমিন আমিন ধ্বনিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আখেরি মোনাজাতে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্যের এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্য দিয়ে রাব্বুল আলামিনের দরবারে ফরিয়াদ জানান।
সকালে ভারতের মাওলানা আকরাম হোসেনের বয়ানের মধ্য দিয়ে শেষদিনের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমানের সংক্ষিপ্ত হেদায়েতি বয়ান শেষে সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটে মোনাজাত শুরু করেন কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা যোবায়ের সাহেব।
প্রথমে আরবি ও পরে বাংলা ভাষায় আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করা হয়। মোনাজাত শুরু হতেই ইজতেমার মাঠ ও আশপাশের এলাকায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। এসময় মাঠ ঘাট, সড়ক মহাসড়কে বসে কিংবা দাড়িয়ে যে যে অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থাতেই মোনাজাতে অংশ নেন।
আখেরী মোনাজাত চলাকালে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। নীরব নিস্তব্ধতা নেমে আসে গোটা এলাকায়। মাঝে মধ্যে এই নীরবতা ভেঙ্গে ‘আমিন আল্লাহুম্মা আমিন, ছুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে মুখরিত ও প্রকম্পিত হয়ে উঠে গোটা ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের এলাকা। আখেরী মোনাজাত হাফেজ মাওলানা যোবায়ের দরুদ শরিফের পাঠর পর কালামে পাকের দোয়ার আয়াতগুলো দিয়ে মোনাজাত শুরু করেন। ২৩ মিনিটের মোনাজাতের প্রথম প্রায় ১০ মিনিট তিনি কালামে পাকের বেশ কিছু দোয়ার আয়াত উচ্চারণ করেন। পাশাপাশি আরবিতে পরওয়ারদিগারের কাছে ফরিয়াদ জানান। এরপর মোনাজাতের বাকি অংশে তিনি বাংলা ভাষায় মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে আকুতি জানান।
তিনি বলেন, ‘ঈমানের চেয়ে বড় দৌলত (সম্পদ) দুনিয়াতে মুসলমানের নিকট আর কিছু নেই। হে আল্লাহ, দাওয়াতে তাবলীগের মেহনতের উসিলায় ঈমানের গুরুত্ব বুঝার তৌফিক দিন। সুন্নতি জীবন গড়ার তৌফিক আমাদের দিয়ে দিন। দ্বীনের দায়ী হিসেবে আমাদের কবুল করেন। ‘হে প্রভু! আপনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাশীল। আমাদের তাওবা কবুল করুন। মুসলমানদের হেফাজত করুন।’ বাংলায় মোনাজাতকালে তিনি মহান আলাহ রাব্বুল আ’লামিনের দরবারে দুনিয়া থেকে শিরক ও বিদআতের খতম কামনা করেন। বাতিলের পরাজয় ও হকের বিজয় চেয়ে বার বার আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানান। দ্বীনের হিজরত ও মেহনতকে কবুল করার আকুতি জানান। বনি আদমের হেদায়েত, উম্মতে মুহাম্মদির জান-মাল হেফাজত, সকল বিমারি থেকে আরোগ্য, সিরাতুল মুস্তাকিম ও ইবাদতে ইখলাস নসিব কামনা করেন। ইহ ও পারলৌকিক মুক্তি, দ্বীনের দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার তৌফিক কামনা এবং তাবলীগের মেহনত ও ইজতেমাকে কবুল করার আকুতি জানিয়ে আখেরী মোনাজাত শেষ করেন।
আখেরী মোনাজাতে মুসল্লীদের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার প্রথম দফায় তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে গত শনিবার বিকেল থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইজতেমা ময়দানে আসতে থাকেন। ট্রেন, বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, জিপ, কার এবং নৌযানসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে শীত ও কুয়াশা ভেঙ্গে ইজতেমা ময়দানে পৌঁছান ধর্মপ্রাণ মুসল্লীরা। এছাড়া শনিবার মধ্য রাত থেকে আখেরী মোনাজাতের পূর্ব পর্যন্ত রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় যানবাহনের অভাবে মুসল্লীরা ভোর রাত থেকেই দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে ইজতেমা অভিমুখে স্রোতের মতো আসতে থাকে।
আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলা মুসল্লীও আগের দিন রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশেপাশে, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাঁদে বসে আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়। ইজতেমায় মহিলাদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা না থাকায় যে যেখানে পেরেছেন সেখানে বসেই লাখো মুসল্লীর সাথে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা : এবারের বিশ্ব ইজতেমায় নজীরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ৮ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ৭ হাজারের অধিক পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি দায়িত্বরত রয়েছে সাদা পোশাকী গোয়েন্দা পুলিশ। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে আকাশে র্যাবের হেলিকপ্টার টহল, নৌ-পথে স্পীড বোটে সতর্ক টহল ও নজরদারী। আকাশ ও নৌ-পথের পাশাপাশি সড়ক পথগুলোতে খালি চোখ ছাড়াও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাইনোকুলার দিয়ে ও ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে মুসল্লীসহ সকলের চলার পথ ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে স্থাপিত র্যাবের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মনিটরিং করা হয়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম জানান, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে আগামী দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শেষ হওয়া পর্যন্ত।
ইজতেমা ময়দানের উত্তর পশ্চিম কর্ণারে করা হয়েছে বিদেশী মুসল্লীদের অবস্থানের জন্য তাশকিলের কামরা। ময়দানের খিত্তাগুলো থেকে চিল্লায় নাম লেখানো ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের জামাতবন্দি করে তাশকিলের কামরায় জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। আখেরী মোনাজাত শেষে এসব মুসল্লীগণ জামাতবন্দি হয়ে তাবলীগের মুরুব্বীদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী জামাতবন্দি হয়ে দ্বীনের দাওয়াতী মেহনতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বেন। এসব জামাতবন্দীদের মধ্যে ৪০ দিন, ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর ও আজীবন চিল্লাধারী মুসল্লীগণ রয়েছেন। তারা বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতি কাজে দ্বীন ও ইসলামের মেহনত করবেন।
ইজতেমায় মোনাজাতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অ্যাড. আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি, স্থানীয় সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. আজমত উল¬া খান, গাজীপুর জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার, গাজীপুর পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সশরীরে অংশ নেন।
প্রথম পর্বে ৮ জনের মৃত্যু : বৃহস্পতিবার থেকে রোববার দুপুর নাগাদ প্রথম পর্বে ইজতেমা ময়দানে মোট আট মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। গতকাল রোববার ভোরে আনিসুর রহমান (৭১) নামে এক মুসল্লির মৃত্যু হয়। তিনি ঢাকার বংশালের মৃত ছমির উদ্দিনের ছেলে। রোববার ভোরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ছাড়া ইজতেমা চলাকালে আরও সাত মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার মলমলিয়া গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলে মুফাজ্জল হোসেন খান (৭০), চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানা সদরের আব্দুর রশিদের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক (৭০), নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার মাসিমপুর গ্রামের রহমতুল্লাহর ছেলে হাবিবুর রহমান হাবি (৭০), সিলেটের জৈন্তাপুরের নুরুল হক (৬৩), ঢাকার কেরানীগঞ্জের হাবিবুল্লাহ হবি (৬৮), গাজীপুরের ভুরুলিয়ার আবু তৈয়ব ওরফে আবু তালেব (৯০) ও ঢাকার মুন্সীগঞ্জ শ্রীনগরের আক্কাস আলী শিকদার (৫০) মৃত্যুবরণ করেন।
ময়দানে লাশের জিম্মাদার মাওলানা মুহাম্মদ শাকের জানান, জানাযার নামাজ শেষে তাদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ফিরতি পথে সীমাহীন ভোগান্তি : আখেরি মোনাজাত শেষে একসাথে লাখ লাখ মুসল্লী ফিরতি পথে রওনা হওয়ায় যানবাহন সঙ্কটে তাদের সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে আসা মুসল্লীদের জন্য গণপরিবহন না থাকায় তারা পাঁয়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ যেতে হয়েছে। অনেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে প্রাইভেটকার, সিএনজি, ভ্যান, মোটরসাইকেল, পিকাপ ভ্যান ও অটোরিকশা করে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছেন। টঙ্গীর কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের আহসান উল্লাহ মাষ্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের সড়ক-মহাসড়ক এবং সংযোগ সড়কগুলোতে দিনব্যাপী দীর্ঘ জনজট ও যানজট দেখা দেয়। যানজট নিরসন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়। রোববার সকাল সাড়ে ১০টা ২০ মিনিটে প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত শেষে হওয়ার পর থেকে সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকা গাজীপুর মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়নি।
আজ সোমবার থেকে চারদিন বিরতি দিয়ে আগামী ২০ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে এ বছরের বিশ্ব ইজতেমা।